গত বছর আমরা একসঙ্গে পালিয়েছিলাম। আমরা কখনো ভাবিনি যে আমরা এটা করতে পারব। কিন্তু আমি আর আমার স্ত্রী সাতচল্লিশ বছর একসাথে কাটিয়েছি। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পর সে আমাকে প্রথমে জাগায় এবং আমরা একসাথে নামাজ আদায় করি।
৪৭ বছরে আমরা কখনও একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকিনি। ঘুম থেকে উঠে তার মুখ দেখাটাই ছিল আমার প্রথম কাজ। আমরা আমাদের ছয় সন্তান নিয়ে কষ্ট করেছি। আগে প্রায়ই আমি আমার পরিবারের জন্য মাত্র একবেলা খাবার যোগাড় করতে পারতাম, তখন আমি এবং আমার স্ত্রী না খেয়ে সারাদিন সন্তানদের খাওয়াতাম। সে কখনও কোন অভিযোগ করেনি, কখনও বলেনি যে স্বামী হিসাবে আমি ব্যর্থ।
এত কষ্টের পরেও আমরা একে অপরের সাথে ঝগড়া করিনি, বিশ্বাস হারাইনি। যখন আমার বড় ছেলে আমাকে নিল এবং ছোট মেয়ে তার মাকে, তখন আমরা বুঝতে পারিনি যে তারা আমাদের আলাদা করে নিতে চাচ্ছে।
আমাদের সন্তানদের আয় সামান্য এবং তাদের নিজেদের খরচ আছে। তাদের সন্তানদের চাহিদা মেটানোর পর আমাদের খরচ তাদের কাছে অনেকটা বোঝা। আমরা সবই জানতাম। কিন্তু আমাদের দুইজনের আলাদা থাকা আমাদের পক্ষে একেবারে অসম্ভব ছিল। আমি নির্লজ্জের মত আমার বড় ছেলেকে তাই জিজ্ঞাসা করলাম এবং সে খুব অবাক হল। সে আমাকে জানালো যে তারা কেউই তাদের বাবা মাকে একসাথে খরচ চালিয়ে রাখার মত সামর্থ রাখে না।
আমি মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রতি সকালে আমি ঘুম থেকে উঠে আমি তার হাসি দেখতে চাচ্ছিলাম। আমি সারাদিন আমার বড় ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকতাম। কারণ সে আসলে আমি তার ফোন দিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারব। কিন্তু প্রায় প্রতিরাতেই দেরি করে ফেরার কারণে অপর প্রান্তে আমার ছোট মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
যেদিন আমি তার গলার স্বর প্রথম শুনতে পারলাম, দুইজনের কেউই একটা শব্দ বলতে পারিনি। আমি অনুভব করতে পারলাম কিভাবে সে তার কান্নাজড়িত গলার স্বরকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে এবং আমি আস্তে আস্তে উল্টাপাল্টা কথা বলতে লাগলাম।
আমি কখনো ভাবিনি জীবন একে অপরকে ছাড়া এভাবে মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন মনে হত আমি দৌড়ায়ে আমার মেয়ের বাসায় চলে যাই; যেটা কি-না অনেক দূরে ছিল। একদিন আমি অনেক সাহস সঞ্চয় করে তাকে বললাম আমি পালিয়ে যেতে চাই তাকে নিয়ে। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে আমাকে সাথে সাথেই এই কাজটি করতে বলল। আমি আমার পথচলার লাঠি হাতে নিলাম এবং আর পিছু ফিরে তাকাইনি। একেবারে নিঃস্ব হাতে আমরা পালিয়ে এলাম।
এখন আমি বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করি। আমি সারাদিনে খুব কম সময়ই ১০০ টাকা উপার্জন করতে পারি এবং বাসায় আসার পর আমি দেখি বিছানায় খাবার আছে। আমাদের সন্তানেরা গত বছর একবার আমাদের দেখতে এসেছিল, তারা আমাদের বলে গেছে কিভাবে আমরা তাদের ব্যর্থ করেছি, কিভাবে আমাদের কারণে তারা ছোট হয়ে গেছে। আমরা কিছুই বলিনি, আমরা তাদের আঘাত করতে চাইনি। তারা আর কখনো না আসার সিদ্ধান্ত নেয়।
মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের জন্য খারাপ লাগে। আমরা তাদের মিস করি। কিন্তু আমরা জানি আমাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। আমি আমার স্ত্রীর থেকে পনের বছরের বড়। যেকোনো দিন রাস্তায় খেলনা বিক্রি করতে করতে আমি মারা যেতে পারি। তাই আমি একটা মাটির ব্যাঙ্ক এ কিছু টাকা জমা করি। আমি চাই না আমাকে দাফন এবং পরবর্তী ধর্মীয় কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য আমার স্ত্রী মানুষের কাছে ভিক্ষা করুক।
কিন্তু প্রতিদিন আমার স্ত্রী তার নামাজের শেষে দোয়ার সময় অনেক কাঁদে। আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করি কেন সে কাঁদে, সে তখন বলে- ‘আমি তোমার সাথে মরতে চাই।’
- সামসুদ্দিন মিয়া (৭৭) এবং তার স্ত্রী রেখা বেগম (৬২)।