এর আগে আমি কখনো গুলশান যাই নাই। গুলশান কেনই বা যাব? ভার্সিটিতে পড়ি, হাকিম চত্বরে চা খাই, চানখারপুলে বিরিয়ানি খাওয়া থেকে হোস্টেলে থাকা বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে বড়জোড় ফার্মগেট—এইটুকুই আমার দৌড়।
এর বাইরে একেবারে গুলশান যখন যেতে হইল তখন অনার্সের সেমিস্টার ফাইনাল শেষ। আর কয়টা সাবজেক্টের অ্যাসাইনমেন্টের মত সমাজবিজ্ঞানের অ্যাসাইনমেন্টও নির্ধারিত সময়ে জমা দিতে পারি নাই। সমাজবিজ্ঞানের হার্টথ্রব সুন্দরী ম্যাডাম ফোনে বললেন উনি আগামী এক মাস ভার্সিটির ত্রিসীমানায় আসবেন না। যারা জমা দিতে পারে নাই তাদের উনার বাসায় গিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে আসতে হবে।
আমাদের ক্লাসে সবাই ভালো ছাত্র। তাই সবাই ঠিক সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিছে। বাকি আছে জেসি, মইনুল আর আমি। হাল ফ্যাশানের পোশাকের সমাজতাত্ত্বিক ব্যখ্যা না ছাই কী যেন একটা অ্যাসাইনমেন্ট।
আমি-জেসি-মইনুল গুলশানে ম্যাডামের বাড়ি যাবার দিনক্ষণ ঠিক করলাম। নির্ধারিত দিনে মইনুল আসে নাই। জেসি আর আমি এসি বাসে চড়ে রওনা হলাম গুলশানে।
জেসি ঢাকার মেয়ে। ধানমণ্ডিতে থাকে। চুল কালার করা। বেশ মোটাসোটা, হাল ফ্যাশনের জামা, জুতা আর লাল টকটকে লিপস্টিক পরা জেসির সঙ্গে আমার কস্মিনকালেও আলাপ হয় নাই। হবেই বা কিভাবে! জীবনে প্রথম আমি খেয়াল করলাম ক্লাসের নব্বই শতাংশ ছেলেমেয়ের সাথে আমার কখনো কথা হয় নাই। আর যে দশ শতাংশ ছেলে মেয়ের সাথে হইছে এদের মধ্যে একটা জিনিস কমন। এরা ঢাকার বাইরে থেকে পড়তে আসছে। এইসব জেসি কিংবা মইনুল—যারা ঢাকার বিভিন্ন কলেজের ছাত্র ছিল তারা কখনো আমাদের মত গ্রাম থেকে আসাদের সাথে মেশে না। আবার গ্রামের ছাত্ররাও মেশে না এদের সাথে।
আমার এই হঠাৎ আবিস্কারে আমি খুবই লজ্জা পাইলাম। কেন এরা একদল আরেকদলের সাথে মেশে না? এই ত্রিশ টাকার এসিবাসের খবর আমি কিভাবে জানতাম ঢাকার মেয়ে জেসি সঙ্গে না থাকলে!
আমি মনের লজ্জা নিয়েই ওর সাথে আলাপ শুরু করলাম। বললাম, চট্টগ্রামে মেয়েরা বাসে ওঠে না। ওঠে হয়ত নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়েরা। কিন্তু মধ্যবিত্ত মেয়েরা বাসে ওঠার কথা চিন্তাও করে না। ওগুলা খুব খারাপ যানবাহন। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য।
জেসি বলল ঢাকায় এটা কমন ব্যাপার। তবে বাস যে সবগুলিই ভালো সেটা না। কিছু কিছু বাস আছে যেখানে মেয়েরা উঠার কথা চিন্তাও করে না। তবে আমরা যেই বাসে যাচ্ছি সেটা এলিট বাস। গুলশান একটা এলিট জায়গা। সেইখানে যে বাস যায় সেটাতে এসি আছে, সে বাসও বেশ এলিট।
বাইরে তখন এপ্রিলের কড়া রোদ। রাস্তায় তাকালে তীব্র সাদা রোদ প্রতিফলিত হয়ে রীতিমত চোখ ব্যথা করে ফেলে। জেসি ওর ঢাউস ব্যাগ থেকে ঢাউস রোদ চশমা বের করে চোখে দিল। সেখানে রং বেরঙের জরি লাগানো। একপাশে একটা বার্বি না কী! আমি অবাক হয়ে গেলাম। মানুষের এত বিচিত্র রুচি কিভাবে যে হয়!
জেসি বলল, জানো তো আমি খুব এক্সাইটেড ম্যাডামের বাসায় যাচ্ছি। উফফ, কী কাকতালীয় ঘটনা বলো! অ্যাসাইনমেন্ট মিস না করলে তো তার বাসায় কোনোদিন যাওয়া হতো না!
আমাদের এই সমাজবিজ্ঞান ম্যাডাম ফাটাফাটি সুন্দরী। অন্তত সুন্দরী মহিলাদের সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত যেসব ধারণা—লম্বা কালো চুল, ফর্সা চৌকস চেহারা, টানা টানা চোখ আর সাদা দাঁতের হাসি সব ক্যাটাগরিতেই উনি একশতে একশ। এই ম্যাডাম পরীক্ষার হলে গার্ড হিসেবে পড়লে ছেলেদের পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়।
ছেলেদের আর কী দোষ! এই সেমিস্টারেরই একটা পরীক্ষায় উনি আমার হলে গার্ড দিচ্ছিলেন। গাঢ় কমলা রঙের পাতলা শিফন শাড়ির নিচে কালো রঙের স্পষ্ট পেটিকোটের উপরে তার ফর্সা কোমরের দিকে আমারই কতবার চোখ গেল! কিন্তু তাতে জেসির কী?
জেসিই খুলে বলল, তুমি কি জানো আমাদের এই ম্যাডাম কার বউ?
আমি দুইদিকে মাথা নেড়ে বললাম, না।
আমি আসলেও কিছু জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে আমার ধারণা ও অভিজ্ঞতা উভয়ই খুবই খারাপ। বিশেষ করে আমার ডিপার্টমেন্ট এর টিচারগুলিকে পৃথিবীর নিকৃষ্ট টিচারদের তালিকায় শীর্ষে রাখা যাবে। এ কারণে এদের ভার্সিটির ক্লাস বা সোশ্যাল ক্লাস কোনোটাতেই আমি কোনো আগ্রহ বোধ করি না।
জেসি বলল, আমাদের সমাজবিজ্ঞান ম্যাডামের বর্তমান স্বামী হুলস্থুল বড়লোক। ম্যাডামের বাবাও বেশ নামীদামী লোক ছিলেন। আর ম্যাডামের প্রথম বর ছিলেন একজন কবি আর এখনকার বর অনেক বড় ব্যবসায়ী।
আমি ফিরে গেলাম আমার ক্লাসের স্মৃতিতে। উপস্থিতি যাতে অন্তত পরীক্ষা দেয়ার মত বজায় থাকে এইজন্য কখনো-সখনো ক্লাসে যেতাম। যদিও যাওয়ামাত্র লাস্ট বেঞ্চে বসে গভীর ঘুমে ঢলে পড়তাম তবু একদিন এক টিচারের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছিল।
কারণ সে টিচার ছিল জিরাফের মত লম্বা। তার ক্লাসে ঘুমাতে একটু কষ্টই হতো পাছে সে গলা বাড়ায়ে দেখে ফেলে! আরেকটা সমস্যা ছিল উর্মি। সেও ক্লাসে ঘুমাত। কিন্তু ঘুমের মধ্যে বাড়াবাড়ি রকমের নাকও ডাকত। ওই শব্দেই হয়ত সেদিন আমার ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম ভেঙে দেখলাম, জিরাফ তার সঙ্গে নিয়ে আসা চোথা থেকে কী যেন রিডিং পড়তেছে। সেইটা ছিল টিচিং টেকনিক ক্লাস। ক্লাসে পড়ানোর সময় কী কী করা যাবে আর যাবে না সেটাই উনি পড়াচ্ছিলেন।
ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে ঠায় দাঁড়ানো একদৃষ্টে চোথা পড়ে যাওয়া টিচার বললেন—ক্লাস নেয়ার সময় কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। শ্রেণিকক্ষের সম্মুখ থেকে পশ্চাৎভাগে হেঁটে হেঁটে পড়াতে হবে তাতে ক্লাসের সব ছাত্রের মনোযোগ বজায় থাকবে আর পেছনের বেঞ্চে বসা ছাত্ররা বঞ্চিত হবে না।
এটুকু শুনে আমি আবার ঘুমায়ে গেছি। এহেন লোক কী উপায়ে ইউনিভার্সিটির মাস্টার হয় এইটা জানার একটা মৃদু কৌতূহল আমার মধ্যে ছিল। জেসির কথায় সে কৌতূহল আরেকটু গাঢ় হইল। তবে কি মামা-চাচা-বাবা-স্বামীর জোর? এভাবেই চলতে থাকবে দেশটা?
জেসি কান ধরে আমার মনটা জানালার বাইরে থেকে বাসের ভেতরে নিয়ে আসল।
বলল, জানতে চাইলা না কোন ব্যবসায়ী ম্যাডামের জামাই?
কী ব্যবসা করলে লোকে হুলস্থুল বড়লোক হয়—আমি জানতে চাইলাম।
উত্তরে জেসি বলল, তারেক জিয়ার বন্ধু সে লোক। অনেক বিখ্যাত। সবাই চিনে। অনেক টাকার মালিক। দেশে বিদেশে ব্যবসা। নিশ্চয়ই বুঝে গেছ কে! আজকে তার বাসায় যাব—ভাবা যায়!
দুপুরের গনগনে আঁচে নাকি বড়লোকের বাড়িতে যাওয়ার খুশিতে কে জানে, জেসির মুখ টকটকে কমলা রঙের হয়ে হয়ে গেছে। আমি পড়ে গেলাম চিন্তায়।
আমি ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে বহু দূরে থাকা একজন মানুষ। তারেক জিয়ার নাম আমি শুনছি কিন্তু তার বন্ধুর নাম শোনা আমার পক্ষে আদার বেপারির জাহাজের খোঁজ রাখার মতই ব্যাপার। আমি তাকে চিনি না সেটাও না হয় সওয়া গেল। কিন্তু এই সদ্য নির্বাচিত আওয়ামী লীগের আমলে তারেক জিয়ার বন্ধুর বাসায় যাওয়া নিয়ে জেসি এত খুশি কেন? সে কি কোনো আশঙ্কা করে না?
চারটা বিশাল রাস্তার একটা মোড়ে আমি আর জেসি নেমে গেলাম। সেই মোড়ের খাবারের দোকান, কাপড়ের দোকান আর ঝাঁ চকচকে সব অফিস দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল।
জেসি ফোন করল টিচারকে। টিচার ধরল না।
জেসি বলল, চল তাহলে কিছুদূর হাঁটি। গুলশান ২ আমি কিছুদূর চিনি।
মোড় থেকে ছোট রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। রাস্তার এপাশে ওপাশে হাঁ করে দেখবার মত সব বাড়ি। এরকমই বাড়ি দেখতে দেখতে জেসি হঠাৎ দাঁড়ায়ে বলল, এইটা। নিশ্চয়ই এইটা। কিন্তু ম্যাডাম ফোন না ধরলে কিভাবে হবে!
একটা তিনতলা প্রাসাদ। সাদা রং। দোতলা থেকে আকাশখোলা প্রকাণ্ড বারান্দা, বারান্দা রেলিংয়ে মোগল স্থাপত্যের কারুকাজ। দেখে শেষ করার আগেই ম্যাডামের ফোন। এটাই উনার বাড়ি।
ভেতরে ঢুকলাম। দুইটা পাজেরো গাড়ি (আমি যেকোনো দামী গাড়ি দেখলেই ডাকি পাজেরো) দাঁড়ানো। সেগুলোর ডান পাশে শ্বেতপাথরের সিড়ি পার হয়ে স্বর্ণখচিত দরজা।
আমার নোংরা, ধুলাপড়া জুতার ছোঁয়ায় শ্বেতপাথর বিশ্রী রকমের
ময়লা হয়ে গেল। আর সেটা দেখে আমি মনে মনে একেবারে মরেই
গেলাম।
আমরা গিয়ে বসলাম একটা প্রকাণ্ড ড্রইং রুমে। সেখানে মোট ১৩ টা এসি। (আমি গুণছি)। কয়েক ডজন সোফা সেট, একদিকে কালো, আরেকদিকে সাদা, আরেকদিকে কফি, আরেকদিকে বাদামী—এইভাবে একেকটা সোফা সেট রাখা। মাথার উপরে যেসব ঝালর বাতি সেইগুলা মুঘলে আজম সিনেমা ছাড়া আর কোথাও দেখছি বলে আমার মনে হয় না।
যে সোফাখান সবচেয়ে কোণায় আর সবচেয়ে কম দামী বলে মনে হইল ওইখানে গিয়ে আমি বসে পড়লাম। ওটাকে বসা না বলে কোনোরকমে পাছা লাগানো বলা যেতে পারে। বাইরের প্রচণ্ড গরমে হেঁটে এসে এই এসির মধ্যে বসা মাত্র আমার শরীর কেঁপে উঠল। আমি যতই এই ড্রইংরুমের পর্দা, এসি, লাইট, ফার্নিচার, শো-পিস দেখি ততই মনে মনে কুঁকড়ে যেতে থাকি। এই সোফায় কিভাবে বসতে হয় আমি জানি না। এই লাইট কিভাবে জ্বালাতে হয় আমি জানি না। এই অ্যান্টিক ফ্যান কী ফ্যান নাকি শুধুই শো এইটাও জানি না। ড্রইংরুমের একপাশ থেকে কাঠের ডিজাইন করা সিড়ির ফ্রেম উঠে গেছে উপরে।
একজন মহিলা কাজের লোক এসে বলল, ম্যাডাম উপরে আছেন। একটু অপেক্ষা করেন। আসছেন।
আমার সামনে জেসি টগবগ করে ফুটতেছে। খুশিতে। তার চোখ ধাঁধানো বিস্ময়ের উত্তাপ আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি।
জেসি আমাকে বলল, আমি এমন লোক বিয়ে করতে চাই। যার এমন স্বপ্নের মত বাড়িগাড়ি আছে। আর তুমি?
আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। তারপর বললাম, আমি বিয়ে করতে চাই না। এমন সময় একেবারে বিপরীত দরজায় দেখা গেল দুইটা ছোট ছোট গোল মুখ। ওখানে ডাইনিং রুম, এরপরে কিচেন।
দুইটা ফর্সা বাচ্চা আমাদেরকে উঁকি মেরে দেখতেছে। আমরাও ওদেরকে ভালো করে দেখতে গেলাম।
এমন সময় শ্বেতপাথরের সিড়ি বেয়ে ম্যাডামকে নামতে দেখা গেল।
শিফন শাড়ি বা লেইস দেয়া পেটিকোট না, পাকিস্তানি লন তার পরনে। তাকে দেখামাত্র জেসির শরীর ১০০ ওয়াটের বাল্বের মত উজ্বল হয়ে গেল।
ও বলল, ম্যাডাম, ওরা কি আপনার ছেলে?
ম্যাডাম হেসে বলল, হ্যাঁ, আমার ছেলে। আসো আসো কাছে আসো, দেখ বাসায় মেহমান এসেছে।
বলামাত্র ছেলে দুইটা উল্টা দিকে ভোঁ-দৌড় দিল।
এক মুহূর্তের জন্য ম্যাডামের মুখের হাসিটা সরে গেল। মুহূর্ত পরে ফিরেও আসল। বলল, কী খবর তোমাদের বল। বাসা চিনতে অসুবিধা হয় নাই তো?
আমি মাথা নাড়লাম। আমার খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এখানে কথা বলার মত সফিস্টিকেশনও আমার নাই। আমি মন দিয়ে ম্যাডামের পেছনের সাদা পর্দাটা দেখতেছিলাম। সাদার ওপর সাদা কাজ। এত সুন্দর সূক্ষ ডিজাইন, মনে হয় স্বর্গের কোনো অংশ।
এমন সময় স্কুল ব্যাগ কাঁধে একটা মেয়ে ঢুকল। বয়স কত হবে। ১১/১২ বছর। মেয়েটা কালো। চেহারা ভালো না। শিশুসুলভ কোমলতা নাই, কোনো স্নিগ্ধতাও নাই। কেমন যেন রুক্ষ আর কর্কশ। সবচেয়ে পঁচা ওর চুল। খুবই রুক্ষ।
ম্যাডাম বলল, আমার বড় মেয়ে। এইবার ক্লাস ফাইভে পড়তেছে। মামণি, ওরা আমার স্টুডেন্ট, হাই বল!
মেয়েটা হাসল না। বলল, হাই। বলে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।
আর ম্যাডাম উঠে গেল উনার ছেলেদের আনতে।
জেসি আমার কানে কানে বলল, এইটা উনার স্বামীর আগের ঘরের মেয়ে।
আমি বললাম, কবির মেয়ে?
জেসি বলল, উহু, এই স্বামীর আগের স্ত্রীর সন্তান। দেখো না চেহারা কেমন—ভালো টালো না।
স্টার প্লাসের হিন্দি সিরিয়ালের মত এত জটিল সম্পর্ক আমার মাথায় ঢুকে না। মাথায় ঢুকে কাজও নাই। আমাকে ফোন করল মইনুল। সেও টিচারের বাসার সামনে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে হাজির।
ও ভিতরে এসেই ধপাস করে একটা সাদা সোফায় বসে গেল!
আমার মত কোনোরকমে ঝুলে থাকা না, একদম গা এলায়ে বসা। তারপর চোখ গোল গোল করে ম্যাডামের বাসার জিনিসপত্র দেখা শুরু করল। আমরাও দেখতেছিলাম তবে চোখের কোণা দিয়ে। আমরা যে বিস্মিত সেটা বুঝতে দিতে চাচ্ছিলাম না।
আর মইনুল পা নাড়তে নাড়তে জোরে বলে উঠল, অনেক বড়লোক, কী বলো?
ওর পায়ের দিকে চোখ গেল আমার। জুতা খুলে আসছে। মোজার আঙুলের মাথায় অন্তত ছয়টা ছয় সাইজের ফুটা।
একটা মানুষ এইরকম মোজা পরে এরকম জায়গায় বসে থাকতে কিভাবে একটুও লজ্জা পায় না!
আমি পর্দা বাদ দিয়ে মইনুলের মোজার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলাম।
ম্যাডাম আসল। তার পেছনে একজন বয়স্ক মহিলা কাজের লোক। তার দুই বাহুতে দুইটা ফর্সা, লাল টুকটুকে ছেলে। চেহারা হুবুহু ম্যাডামের মতন। তারও পেছনে একজন কমবয়সী কাজের লোক। হাতে একটা ট্রলি। ট্রলির ওপরে সন্দেশ, লাড্ডু, পানি আর চা।
খাবারগুলি একটা সুন্দর টেবিলের ওপরে রেখে কমবয়েসীজন চলে গেল।
আর বেশি বয়েসীজন আমাদের সামনে দাঁড়ায়ে থাকল। দুই কোলে দুই ছেলে জাপটে ধরে আছে তাকে।
টিচার বলল, আমার দুই ছেলে। ওর বয়স তিন, ওর বয়স চার। সে হ্যালো ট্যু দ্য গেস্ট ডার্লিং।
দুজনই তাদের বড় বড় কালো অবিশ্বাসের চোখে আমাদের দিকে তাকায়ে থাকল।ওদের দুধে আলতা গায়ের রঙ,লাল টুকটুকে ঠোঁট আর দেবশিশুর মত চেহারায় বিস্ময়, কিছুটা যেন ভয়।
বড়জন কোল থেকেই মুখ খুলল। স্পষ্ট ব্রিটিশ উচ্চারণে বলল, হ্যালোউ, হাউ ডু ইউ ডু!
জেসির খুশির ছটা ছলকে পড়ল আমার গায়ে।
বড়জনের দেখাদেখি ছোটজনও বলল, হ্যালোউ, হাউ ডু ইউ ডু?
এমন সময় কাজের লোকটা ওদেরকে কোল থেকে নামায়ে দিতে চাইল। বলল, আফনেরা নামছুইন না ক্যারে, আম্মার কুলে যান। আম্মার কাছে যান।
বড়টা একটুখানি নামল। নামার মাঝপথে বলল, আমি নামতাইম না। ডর করে।
খাঁটি মৈমনসিংগা বাংলা।
ম্যাডাম খুবই বিব্রত। তার ভ্রু কুঁচকে গেল। আমতা আমতা করে আমাদের দিকে অপ্রস্তুত হেসে বলল, ওরা বুয়ার কাছে বেশি সময় থাকে তো! বাংলাটা একদম বুয়ার মত বলা শিখেছে। এসো বাবা, আমার কাছে এসো। মায়ের কাছে আসো দেখি।
ছোটটা এমন সময় বলে উঠল, আম্মু? আম্মু তো বাড়িত নাই।
সেই মৈমনসিংগা টোন। কিন্তু ব্যাপার তো সেটা না। ব্যাপার হল মা তাদের সামনে বসা। আর ছেলেটা বলতেছে মা বাসায় নাই?
কাজের মহিলাটা কঠিন স্বরে বলল, কে কইছে আম্মু নাই? আম্মু আছে তো! এইডা কি আম্মু?যাও, যাও আম্মুর কোলে যাও।
বলে ওকে ম্যাডামের কোলে দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ও প্রবল শক্তিতে দুইদিকে মাথা নেড়ে বারবার বলল, না, না, আম্মু বাসায় নাই। বাইরে গেছে। আম্মু তো বাসায় নাই।
সে আঁকড়ে ধরল কাজের মহিলাকে। ওর দেখাদেখি ওর বড় ভাইও সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরল মহিলাকে। বলল, শি ইজ নট অ্যাট হোম। শি ইজ নেভার এট হোম।
চারপাশের ঝাড়বাতি আর শুভ্র পর্দাগুলি ফিকরে দুপুরের আলো আসা ঘরটা যেন এক ঝলকে অন্ধকার হয়ে গেল। কাজের বুয়া ভেতরে নিয়ে গেল ওদেরকে। আর ম্যাডাম অস্বস্তিতে কুঁচকে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু হেসে বললেন, আসলে ওদের একটু স্পিচ ডিলে আছে। কথা বলছে দেরিতে। আমরা দুজনই থাকি ব্যস্ত। ওদের সাথে দেখা হয় কম। এজন্য ওদের কথা শিখতে একটু দেরি হয়ে গেছে।
জেসির মুখে খুশির ছটা একটু কমে গেছে। আমি চুপ।
মইনুল ওর ছেঁড়া মোজা পরা পা নেড়ে নেড়ে বলল, স্পিচ ডিলে মানে তো কথা বলতে দেরি হওয়া। আপনাকে চিনতে পারছে না কেন?
ম্যাডামের মুখ এখন হয়ে রক্তশূণ্য। সাদা। বিবর্ণ। নিজেকে সামলে নিলেন মুহূর্তেই। হেসে বললেন, আসলে আমাদের সাথে ওদের দেখা হয় কম। সারাদিন ভার্সিটি সামলে তারপর আবার খবর পড়তে যেতে হয়। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। ওরা তো তখন গভীর ঘুমে।
বলে আবার হেসে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন।
ম্যাডাম টিভিতে খবর পড়েন! জানতাম না। কোথা থেকে জানবো? কোনদিনও টিভি দেখি না আমি।
জেসি খুশিতে গদগদ হয়ে গেল হঠাৎ। বলল, ম্যাডাম বিটিভির সবচেয়ে স্মার্ট প্রেজেন্টার আপনি। আমি কখনো ইংলিশ বুলেটিন দেখতাম না। শুধু আপনি যেদিন নিউজ পড়তেন সেদিন আমি হাঁ করে ইংলিশ বুলেটিন দেখতাম। এখনো পড়েন আপনি? জানতামই না তো আমি! জানলে এখনো দেখতাম।
ম্যাডামও খুশি হইলেন খুব। বললেন, হ্যাঁ পড়ি, কিন্তু কমিয়ে দিয়েছি। এই যে ওরা সময় পায় না, ওদের কথা ভেবেই আর দেশের রাজনৈতিক অবস্থা তো দেখছোই। আমাকে তো শিক্ষকতাই করতে দিচ্ছে না। কী যে চলছে আমার বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টে—তোমরা কল্পনাই করতে পারবে না। যাই হোক, আজ তোমরা আসো। আরেকদিন আসবে। তোমাদেরকে আমার বাড়ির তিন তলার লাইব্রেরিটা দেখাব। কেমন?
আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম।মইনুল উঠল না। বলল, আজকেই দেখি? আরেকদিন কেন?
ম্যাডাম বলল, ওহ আজকে আমার একটু বাইরে বেরুতে হবে। জরুরি অনুষ্ঠান। এইজন্য আজকে তোমাদের বেশি সময় দিতে পারলাম না।
ম্যাডাম আবার হাসল। কিন্তু হাসিটা কেমন যেন–নাকি আমারই মনে হইল– প্লাস্টিকের হাসি, কে জানে!
আমরা বের হয়ে আবার গুলশানের ছোট গলিতে হাঁটতেছি। এপ্রিল মাস। তবু অনেক জোরে কোকিল ডাকতেছে। কুহু কুহু।
জেসি মইনুলকে বলল, আমি এমন ছেলে বিয়ে করব। যার অনেক টাকা। আমার এমন সুন্দর দুইটা ছেলে হবে। গুলশানে বাড়ি থাকবে।
মইনুল বলল, আর ছেলেগুলি তোমাকে চিনতে পারবে না।
জেসি বলল, কে বলছে চিনতে পারে নাই? টিচার না বলল ওদের ডিলে আছে! আমার ভাইয়ের বাচ্চারও ডিলে আছে। আমি জানি। এরকম হতেই পারে। একটু স্পেশাল বাচ্চা এরা।
মইনুল বলল, স্পেশাল বাচ্চা আর এরা এক না। এরা ডিপ্রাইভড।
জেসি ক্ষেপে গেল। বলল, মইনুল তুমি একটা গরীব, খ্যাত। আমি এক্ষুণি আমার আর্মি বয়ফ্রেন্ডকে ফোন দিচ্ছি।
ও সত্যি সত্যি ওর বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করল। বলল, তুমি বিদেশে দুইটা মিশন করে আসলেই তো এরকম বাড়ি গাড়ি কিনতে পারবা গুলশানে। জলদি যাও। আফ্রিকা যাও, কঙ্গো যাও। জলদি যাও, জলদি। আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না।
মইনুল আমাকে বলল, পারমিতা, তোমার মত কী? তোমার কী মনে হয় বাচ্চা দুইটা তাদের মাকে আদৌ চেনে?
আমি তখনো গুলশানের চোখ ধাঁধাঁনো প্রাসাদসম বাড়ি দেখতেছিলাম। যাওয়ার সময় এগুলিকে যেমন মনোমুগ্ধকর,আকর্ষণীয় বস্তু মনে হচ্ছিল, ফেরার পথে কেন যেন এগুলিকে আর ঠিক তেমন মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছিল আগলি, যেমন বাংলা সিনেমার পোস্টারে মোটা নায়িকার অস্বাভাবিক বুক কিংবা পাছা—এ বাড়িগুলি কোথায় জানি তেমন।