রহিম পরামানিকের সংসারে খুব টানাপোড়েন।নিজেদেরই ভালো করে পেট চলে না।একবেলা আধবেলা খেয়ে কোনরকম
মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়।তেমন কর্মও জোটে নি ভাগ্যে।কখনো জেলেদের সাথে জাল টানার কাজ আবার কখনোবা গ্রামের মাতব্বর ধরনের মানি ব্যাক্তিবর্গের বাড়িতে দিন মজুরের কাজ।আর এভাবেই কোন রকম কষ্টে দিন কাটছিল।
রহিম পরামানিকের স্ত্রী হামিদা বানু।বয়স বাইশ ছুঁই ছুঁই।কোন সন্তানাদি এখন পযর্ন্ত হয় নি।রহিম পরামানিক অশিক্ষিত।পেটে বিদ্যার কোন বালাই নেই।তাই তার প্রতিটি অযোগ্যতার জন্য প্রতিনিয়তই যাকে দোষারোপ করে সে আর কেউ নয়,তার বিয়ে করা স্বামী ভক্ত স্ত্রী হামিদা বানু।
অশিক্ষা ,দারিদ্রতা এমন পর্যায়ে এদের রক্তে মিশে গেছে যে, ভালো মন্দের বাছবিচার বোধ হারিয়ে গেছে।এরা বুদ্ধি ধার করে চলে।আবার অনেকে বুদ্ধি ভিক্ষাও চায়।এরা চেনে না বিচারালয়।ভালো চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নেয়াটা এদের কাছে এক রকম বিলাসিতা।শারীরিক অসুবিধাগুলো নিমেষেই গায়েব হয় বা হতে হবে তাও সমাধান গায়েবি চিকিৎসা কেন্দ্রের মাধ্যমে।কি অদ্ভূত বিচার আচার।হামিদা বানু আর রহিম পরামানিকরা যেন এদের নিত্য গ্রাহক।
হামিদা বানুর সন্তানাদি না হওয়ার জন্য সমাজে রহিম পরামানিকদের ওপর নেই কোন বাড়তি চাপ।মহিলারাই একমাএ এর জন্য নির্দিষ্ট অপরাধী।তাই কথায় কথায় বাড়তি কথাগুলো হামিদাদের জন্য অপেক্ষমান।রহিম পরামানিকও তাই ভেবে, সবসময়ই হামিদার দিকে আঙ্গুল তোলে।প্রায়ই তার মাতৃত্বের অপূর্নতাই যেন রহিমের বেকারত্বের অন্যতম বিরাট কারণ, বানিয়ে নিজের অপরাগতাকে ঢাকতে চায়।হামিদা বানুরা সব বোঝে কিন্তু স্বামীকে এসব প্রশ্নে জড়ানোকে কবীরা গুনাহ মনে করে।কোনমতেই তারা স্বামীর পায়ের নীচে অবস্থিত জান্নাতকে হারাতে নারাজ।তাই নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে যায় আজীবন।
আজ শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।তাই রহিম পরামানিক কাজে না যেয়ে বাড়িতেই বিশ্রাম নিবে ভাবছে।ওদিকে মাসখানিক হলো হামিদা বানুরও শরীরটা ম্যাজম্যাজ করে কিন্তু কি আর করার আছে দারিদ্রতা,ক্ষুধাই যেন অন্তরঙ্গ সঙ্গী সেখানে নিজেকে নিয়ে আলাদা করে ভাবারই ফুসরত নেই।তবুও রহিম পরামানিককে বাড়িতে পেয়ে একটু অন্তরঙ্গতার ছুতোয় আস্তে আস্তে রহিম পরামানিকের মুখের সামনে যেয়ে কয়েকটি নাড়ু এগিয়ে দেয়। অযথা মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, রহিম পরামানিক হামিদার কাছে জানতে চাইলো সে কিছু বলবে কিনা।
কি কথা দিয়ে যে হামিদা বানু কথা শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।তারপরেও সাহস করে বলেই ফেলল আজ কয়দিন হলো মুখটা কেমন জানি চুকা খাইবার চাই। শরীলডা কেমন জানি করতাছে।মাথাডার মদ্যে মাজেমদ্যেই কেমন জানি চক্বর দিতাছে।আমারে একটু ওষুদ আইনন্যা দিবা!ভাত পাইনা হে আবার ওষুদ খাওনের চায়।যত্তসব।আবার হামিদা বানু একটু সাহস সঞ্চিত করে আবার শুরু করে।তাইলে কাল একটু গনি কবিরাজ চাচার কাছে লইয়া যাইবা?আচ্ছা,আগে কালতো আহুক,তারপরে দেহুমনে।এখন আমারে একটু একলা থাকবার দেও তো।কি হইচে?কিছু যে কওনেরই উপায় নাই।
হামিদা বানুর একথা শুনে রহিম পরামানিক আরো রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে ঐ দূরে নারকেল গাছের কোল ঘেষে আপন মনেই ভেবে চলছে।আহারে বিয়ার এতগুলা বছর পার হইছে তবুও কোনকিছুর জন্য কোনদিনও হামিদারে দেহি নাই আমার কাছে কিছু চাইতে।আজ একটা আবদার করলো আর আমি এমন পশুর মতো ঝাকাইলাম ওর লগে কামডা মোটেও ভালা করি নাই।যাই ওদিকটায়।হামিদা,কাল বেয়ানে কবিরাজ চাচার ঐহান দিয়া ঘুরাই আনমুনে।হামিদার সুখ যেন আর ধরে রাখতে পারে না।কত্তদিন রহিম পরামানিক তাকে কোথাও নিয়ে যায় না।এই ছুঁতনোতে একটু বাইরেও যাওয়া যাবে।মনেমনে হামিদা ভাবে কি হইছে আমিতো জানি।ময়না ভাবীসাবের পেটে বাচ্চা আসলেও হেরও নাহি মাতা গুরাইতো, বমি চাপতো,আর খালি চুক্কা খাইবার লেইগগা ছুচকার মতো করতো।তারপর নয়মাস পর পোলা হইলো।মনের ভাবনাটার সত্যতা যাচাইবাছাই করার জন্য এত আয়োজন।হামিদার কত দিনের সখ সেও পোলার মা হইবো।
পরেরদিন সময়মতো হামিদাকে কবিরাজ বাড়ি দেখাতে রহিম পরামানিক নিয়ে আসলো।এখানেও অনেক ভীড়।হামিদার মতো কত মানুষরা গনি কবিরাজের দাওয়াই নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে তাদের সংখ্যা যে অগনিত।যথাসময়ে হামিদার দেখানোর পালা আসলো।হামিদার চোখ দেখলো।নাড়ীও দূর্বল।এছাড়া সব বৃত্তান্ত শুনে গনি চাচা বললো,রহিম এরপর মিঠাই নিয়া আসবা মিয়া।তোমার বউ যে পোয়াতি।একথা শুনে রহিমের বুকের পাজড় যেন গর্বে আরেকটু প্রসস্থ হয়ে উঠলো।হামিদা কাপড়ে মুখ ডেকে মিটমিট করে হাসতে লাগল।
যথাসময়ে হামিদা বানুর পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হলো।রহিম পরামানিকের সাথে মিল রেখে নাম রাখলেন জব্বার পরামানিক।জব্বার আসার পর কিছুটা হলেও তাদের আর্থিক উন্নতি ঘটে।তবে জব্বারের বয়স যখন নয় বছর তখন দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থেকে রহিম পরামানিক ইন্তেকাল করেন। হামিদা বানু অনেক কষ্টে ছেলেকে বড় করেন।মায়ের সাথে সাথে সেও একরত্তি বয়স থেকে পরিশ্রম করেন।মা ছাড়া আর কে আছে জব্বারের।
জব্বারও সময়ের ব্যবধানে বড় হয়ে উঠলো।টগবগে তাজা জোয়ান পুরুষ হয়ে উঠেছে।হামিদা বলে উঠলো,জব্বার আমি আর কয়দিন!বাজান তুই এবার একটা ভালা মাইয়া দেইখখা বিয়া কর।সংসারী হ বাজান।আমি থাকতে থাকতে তর সংসার দেইখখা যাই।চুপ থাকলো জব্বার কিন্তু কথাটা তার খুব মনে ধরছে।সত্যিই তো বিয়া করার বয়স হইছে।
হামিদা এবার বিয়ের তোরজোর তুলে দিলেন। আদেশ জারি করলেন একমাসের মধ্যেই ছেলের বিয়ে দিবেন।ভালো দিনক্ষণ দেখে পাশের গ্রামের চুন্নু ব্যাপারীর মেয়ে সকিনা বেগমের সাথে জব্বারের বিবাহের কার্যাদি সম্পন্ন হলো।সকিনা একটু শ্যামবর্ণের ছিল ভারী মিষ্টি তার চেহারাটা কিন্তু জব্বার ছিল খুব ফর্সা বর্নের।মায়ের পুরো রুপটায় যেন সে পেয়েছিল।তবু এ নিয়ে হামিদার কোন কিছু বলার নেই।জব্বার সকিনাকে নিয়ে খুব সুখী।বিয়ের আগে জব্বারের তেমন কর্ম না থাকলেও বিয়ের বদৌলতে শ্বশুরের কাছ থেকে বিঘা সাতেক জমি পেয়েছে।আবাদি কাজে লাগিয়ে আগের চেয়ে ভালোই আছে।এদিকে বছর না যেতেই সকিনা মা হবার সৌভাগ্য অর্জন করল।
জব্বার পরামানিক তার জমিতে ধান,আখ,কলাই ইত্যাদি ফসল উৎপাদন করতেন।ধীরে ধীরে জব্বারের পরিবারে নতুন অতিথি যোগ হচ্ছে ও সদস্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।হামিদা বানুও বয়সের ইশারায় জরার সাথে সখ্যতা করছে।দিনে দিনে এই সখ্যতা বেরেই চলেছে।জব্বারের স্ত্রী মেয়ে সন্তান জন্ম দিলেন।নাম রাখা হলো জমেলা খাতুন।জমেলাকে নিয়েই হামিদা বানুর সময় বেশ ভালোই কাটছিল। নিজেরওতো মেয়ে সন্তান ছিল না! তাই নাতনি জমেলা যেন আদরের পুরো জায়গারই মালিক।তবে শিক্ষাগত ঘাটতির দরুণ সকিনার মাথায় সারাদিন একটা কথায় শুধু ঘুরপাক খেত, কবে সে ছেলে সন্তানের মা হবে?এসব স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনাতে সকেনারা তাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখে না।জমেলাকে সে একরকম তার শ্বাশুড়ি হামিদা বানুর কাছেই ফেলে রাখে।মেয়ে হয়ে জন্মে যেন, জমেলা বিরাট পাপ করেছে।এদিকে এটুক ওটুক চাট্টাচুট্টোর ওপরই সকিনা থাকছে। বাপের বাড়ি থেকে আজ আবার আচার পাঠিয়েছে।গোপনে আচার খেতে যেয়ে হামিদা বানুর কাছে ধরা পড়ে যায়।হামিদা তাকে বলল,কি বউ তোমার কি হইছে?তুমি ছোড পোলাপানের মা চুক্কা খাও এইডা কেমন কতা হা।সকিনা জবাব দিল শরীলটা ভালা যাইতেছে না।তাই একটু চুকা খাইবার লইছিলাম।
কিছু দিনের মধ্যেই তার মা হতে যাবার খবর ছড়িয়ে পরলো। গ্রামে এদৃশ্য নতুন নয়।এখানে একটি শিশু ভালোকরে হাঁটতে শিখছে কি শেখেনি, ওমনি তাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হয় তাদের আদরে কেউ বুঝি ভাগ বসাতে আসছে।সত্যিই এবার সকিনার পুত্র সন্তান হলো।নাম রাখা হলো কামাল পরামানিক।জব্বার মাঠের কাজ নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে।না থেকেও উপায় নেই।দিনে দিনে ঘরের সদস্য বাড়ছে চিন্তাতো একটা থাকবে।হামিদারও শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।কখন জানি কি হয়।না আছে ডাক্তার না আছে পথ্য।এই ধুকে পুকে যেকদিন যায়।
হামিদাও অসুস্থ থাকার কারণে আগের মতো আর জমেলার দেখভাল করতে পারে না।কারণ সেও আর কাঁথায় থাকার মতো যে নেই।এখন সে সারাদিন তার চির পরিচিত আবাস কাদা দিয়ে ধুলাবালি নিয়ে মেতে থাকে।আরেকটু অভিজ্ঞ হবার জন্য চেয়ে থাকে পড়শী অগ্রজ সহোদরের দিকে,যদি আরেকটু পাকা পোক্ত হয়ে ওঠা যায়।এদিকে দুটি বাচ্চাই ছোট,সংসারের কাজকর্ম।মাঠের বিভিন্ন রকমের কাজের সহায়তা সব কিছু নিয়ে প্রায় হাপিয়ে উঠছিল সকিনা।তাই জব্বারের কাছে তার আবেদন তার দূর সম্পর্কের ফুপুকে তাদের কাছে এনে রাখবে।জব্বার শুনে অমত করলো না।
হামিদা বানুর কাশিটাও খুব বেড়েছে।এবার বোধহয় আর টিকবেন না।সত্যিই!তাইহলো।ওদিকে মাঠের ধান কাটার সময়, জব্বার একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।মায়ের যে শরীরটা খারাপ চলছে সেদিকে চিন্তা থাকলেও,নেই একটু পাশে বসার সময়।দিন সাতেক পর দুপুরের দিকে মাঠে লোকজন নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় কাটছে জব্বারের।কেউ একজন এসে জানিয়ে গেল ও মিয়া,তাড়াতাড়ি বাড়ী যাও।চাচির তাজা মুখটা যদি দেখবার চাও।জব্বার কেঁদে উঠলো মায়ের কিছু হইল নি!এক দৌড়ে আসতে আসতেই হামেদা বানু পরপাড়ে পাড়ি দিয়েছেন।ছেলের সাথে শেষ সাক্ষাত তার হলোনা।
এদিকে বছর চারেকের মাঝে সকিনা আরও এক পুত্র এক কন্যা সন্তানের মা হলেন।সদস্য দাড়ালো ছয় জনের।এভাবে বারবার মা হতে যেয়ে সকিনার শরীরটাও ভেঙ্গে গেছে।তাই গোপনে কবিরাজের কাছ থেকে দাওয়াই এনেছে জব্বারকে না জানিয়ে।একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা।আর যে পেরে উঠছে না।এই দুটোর নাম জেদু পরামানিক আর কন্যা রুপভান খাতুন।রুপ যেন তার উথলিয়ে পড়ে।রুপভান হয়েছে অনেকটাই তার দাদীর মত।তাই জব্বার খুব ভালোবাসে তাকে।নাম ধরে ডাকে না মা বলে সম্মোধন করে।
দিনে দিনে সময় এগিয়ে কখন যে বেলা গড়িয়ে সাঁঝ তা কারো খেয়ালই নেই।জমেলা,কামাল,জেদু ও রুপভান সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে।জব্বারেরও আগের সেই খাটুনি করার শক্তি নেই। দুছেলের সাথে করে মাঠের কাজকর্ম করে। ছেলেরাই বেশীরভাগ কাজ করে সে শুধু এখন তাদের পাশে থেকে শেখায়।আজ জব্বার বাড়ী ফিরলে সকিনা হাতপাখার বাতাস করছে আর বলছে,একটা কতা কমু।কি কওনের চাও কইয়া ফেলাও।কইতাছি,আমাগো জমেলা ডাঙ্গর হইয়া ওঠছে সেদিকেও তো নজর দেওয়ন লাগবো।কি করতে কও।ওত না প্যাঁচাইয়া সোজাসুজি কতা কওন কবে শেখবা।হ, ঐ আমার ছমেদা বুজানের কথা মনে আছে?হ্যারই বড় পোলা রমিজের লগে আমাগো জমেলার বিয়া হইলে মন্দ হইতো না।তাছাড়া পোলা মাছের খামারে কাম করে।স্বভাব চরিত্রও ভালা।একটু দেখতা যদি।ঠিক আছে এত তাড়াহুড়ার কি আছে?আগে ব্যাপারডা বুইজজা লই।সকিনা একটু রেগে,হ মাইয়া মানুষ বেশি বয়স কইরা বিয়া দিতে গেলে আর ভালা পোলা পাওন যায় না,যত্তসব।
এদিকে জমেলার জন্য তার মায়ের পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়ের আয়োজন করা হলো।যার যতটুক সামর্থনুযায়ী বিয়ের কার্যাদি শেষ করা হলো।এভাবে আরো বছর চারেক বাদে বড় ছেলের বিয়ে দিয়ে জব্বার পুত্রবধূর মুখ দেখলেন।জব্বার আর আগের মত খাটুনিও করতে পারে না।এরই নাম বুঝি বয়স।ছেলেদের সংসারের বোঝা হতে চলেছে সে আর তার স্ত্রী।কতকিছু পাওয়ার থাকলেও মুখে ছিপি এটে দিতে হয় মেকি সুখী হবার অভিনয়ে।জ্বালায় জ্বলে শুধু মন।গুমরে কান্না পায়।কতদিন মায়ের সাথে সময় না দিয়ে কাজের ছুতোয় অবহেলা করেছে।মায়ের কাশির অসুখ জেনেও কোন পথ্য এনে দেয় নি। বউ বলেছে গরম পানি খেলেই গলায় আরাম হয় ঔষধ লাগে না।তাই অন্ধের মত বিশ্বাস করে পাপ করেছে।আজ তারও কদিন জ্বর জ্বর।প্রচন্ড গা ব্যথা।কিন্তু কারো যেন সেদিকে ভ্রক্ষেপই নেই।বয়স হলে নাকি একটু আধটু শরীর খারাপ হয়।সকেনা যেকোনো ছুতোই জব্বারের কানেবড় ছেলে বৌমার ত্রুটি তুলে ধরতে চায়।দেহো,দুইদিন যাইতে না যাইতেই তোমার পোলা বউয়ের গোলাম হইছে। এতকথা হুনাও ক্যা।হুনামু না একবারো বাপের লেইগ্যা ওষুদ আনছে।কিল লিগগ্যা আনবে?তুমি কোনদিন আমার মার ওষুদ আনবার লিখগ্যা কইছো যে হে শেখবো।আজ আর কাইল।সময় সব একই।
একথা শুনে সকিনার ভেতরটা ভয়ে কেমন জানি দুমরে মুচরে গেল।সবই তাইলে আমার দোষ। হের যে কামাই ছিল না তহন হেকতা কইলে তো এহন আমিই খারাপ হমুনে।যাক যা কপালে আছে তাই হইবো।অত ভাইববা কোন লাব নাই।ওদিকে বড় মেয়ে জামাই তাদের অর্থ কষ্টের সংসারে হেসে খেলে একরকম ভালোই দিন কাটাচ্ছে। সেঘরে দুটিই মেয়ে।আর বাচ্চাকাচ্চারও সখ নেই।ওতেই জমেলা রমিজ মহাখুশি।রমিজের চাওয়া পাওয়া সারা জীবনই কম।একেবারে সাদামাটা।মনের মধ্যে কোন দোষ রাখে না।
কামাল আর জেদু গায়ের খাটুনিতে জমিতে আবাদ করে কোনরকম তিনবেলা ছেলেপুলে নিয়ে খেয়ে সংসার চালাচ্ছে।জব্বার পরামানিকের এখন আর কিছু করারই বয়স নাই।মনে মনে ভাবছে রুপভানের একটা বিয়ে থা দিতে পারলে তার ছুটি।মরনেও আর কষ্ট থাকত না।এরমধ্যে তার শরীরটা বেশিই খারাপ হচ্ছে।তারই চাচাত ভাই সিরাজ পরামানিক।বহুদিন ধরে ঘটকালির কাজে নিয়োজিত।মেয়া ভাই কেমন আছো?আমারে সংবাদ পাঠাইছ শুননা আসলাম।তা কি ব্যাপার জেদুর লিগগ্যা মাইয়া দেখন লাগবো নি। হ।হেইয়া তুমি ঠিকই কইছো।মরনের আগে পোলাপান কয়ডারে সংসারী দেইখখা মরতে পারলে আর আফসোস নাই।মেয়া ভাই,আমার ময়নারে জেদুর লগে বিয়া দিলে কেমন হয়। কই, মা মরা মাইয়া কোন ঘরে দিমু।ভাবিসাবতো ওরে খুব সোহাগ করত ছোডবেলায়।ভাবিসাব কি কন?আমারতো ঐ একটাই মাইয়া।মাঠের ঐ চার বিগি সম্পদ আমি জেদুরে দিবার চাই।না করবার পারবার না।তাইলে ঐ কতায় থাকলো।এই ফাগুনেই তাইলে ভালা দিন দেইখখা শুভকামডা সাইরা ফেলুমনে।জব্বার ভাবল,কি কমু আর কি হইলো।যাক ভালোই হইলো।জেদুরেও বিয়া দেওন দরকার।
এভাবে আরো দুবছর অতিক্রম হয়ে রুপভান এগারো বছরে পা দিল।সারাদিন সখিদের নিয়ে মাঠ ঘাট মাড়িয়ে বেড়ায়।এখনো পুকুরে নামলে ঘন্টা দুয়েক লাগিয়ে দেয়।সকিনা ছড়ি নিয়ে না এগুলে রুপভানকে উঠানো যায় না।কখনো আখ ক্ষেতে,কিংবা কখনো ছাগল চড়াতে মাঠে বনে বাাঁদাড়েই তার নিশ্চিন্ত আবাস ভূমি।একমাত্র সকিনার চিল্লাচিল্লিতেই সে বেড়িয়ে আসে।নাহলে কারো সাধ্য নেই তাকে খুঁজে বের করার।এদিকে বড় ভাবির সাথে তার খুব সখ্যতা। তাই প্রায় তার বাবার বাড়িতে কয়েকবার সে গেছে বেড়াতে।ঐ বাসাতেই ছোট বেলা থেকে থেকে খেয়ে বড় হয়েছে আব্দুল রহমান।টগবগে যুবক । পান খেয়ে প্রেমিক মনটাকে সব সময় আরো রঙ্গিন করে রাখে। কি জানি রুপভানকে দেখলেই সে যেন কেমন একটু উদাসীন হয়ে যায়।সারা দিন গলায় গান বাজতেই থাকে।
এবারো রুপভান আর তার বড় ভাবি প্রায় দিন পাঁচেক বাপের বাড়িতে বেড়ালো। আব্দুল রহমান যতই রুপভানকে দেখছে ততই তার মনের মধ্যে সংসার,প্রেম, জাগরিত হচ্ছে।কিন্তুএসব নিয়ে রুপভানের কোন ভাবনাই নেই। কয়েকদিন সখিদের কাছে না যেতে পেরে তার মন খুবই খারাপ।
ভাবিসাব চল,এবার আমাগো বাড়িতে ফিররা যাই আর থাকবার পারছি না।তাই ভানু!যহন সোয়ামীর লগে থাহন লাগবো কি করবি?আমাগো লিগগা ছটফট করবি তো ভানু।আব্দুল রহমান কেবলই দুপুরের খাবার খেতে আসল।ভানুর ভাবির মা আর রহমানের মা ধর্মের বোন পাতিয়ে ছিল।সেই সুবাদে এত কিছু।রহমান এ বাড়িতে নিজ ছেলের মতই মর্যাদা নিয়ে চলে।
একবেলা রিকসা চালায় তো অন্য বেলা গান গেয়ে আড্ডা মেরে আনন্দে কাটায়। ননদ ভাবির কথাগুলো সবই রহমানের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে। তবুও না শোনার ভান করছে। খুব জোড়জবস্তি করে আরেকটা দিন ভানুর ভাবির মা তাদেরকে কাছে রাখলো। হাটের থেকে নতুন কাপড় কিনে আনালো।যাওয়ার সময় ওসব পরিয়ে তারপর না বিদায়।নতুন লাল রঙ্গের শাড়ীতে ভানুকে যে কি অপূর্ব লাগছিল তা বলবার কথা নয়।কি মিয়া আমার ননদের প্রেমে পড়ছো? বিয়া করবার নি?তয় এরহম একবেলা রিকসা চালাইলে বউ ভাত দেয়া যায় নি?
সত্যিই কথাটা কিন্তু আফায় ঠিকই কইছে।কামাই না থাকলে কি খাওয়ামু!এদিকে মনে মনে সাহস যোগাচ্ছে বিয়ের কথাটা এবার বলেই ফেলবে।মাস ছয়েক পর রুপভানের ভাবি আসল তার বাপের বাড়িতে শীতের পিঠা খেতে।প্রত্যেক বারই বিভিন্ন রকমের শীতের পিঠা বানিয়ে বেয়ান বাড়িতে সকলের জন্য পাঠান।হঠাৎ রহমানের চোখে চোখ পড়লে ভানুর ভাবি তামাসা জুড়ে দিল।কি মিয়া,ভানুরে খোঁজ?হে আহে নাই।না। ওঃ।আহারে ছয়মাস হইলো মজনু লাইলীরে দেহে নাই।হি হি।তা এতই যহন পোড়ানি বিয়া কইরা তারে নিজের কইরা নেও না। আমারে তারা মাইয়া দিব?আমর তো তেমন কিছু নাই।জোয়ান মরদের কাম করার শক্তি থাকলে আর কিছু লাগে না।আমার হইয়া আপনে আফা কতাটা যদি তোলতেন!দেখতাছি কি করা যায়।
এবার বাড়ি ফিরে এসে ,তার শ্বশুরের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বললে কেমন হয় এ নিয়ে কয়েকদিন ধরেই ভাবছে।এক সময় কথাটা তুললে সকিনা বেগম বেশ আপত্তি করলো।আমার ওইরহম চাঁন্দের মত মাইয়া আর ওই পোলা।চাল নাই চুলা নাই।এবার জব্বার পরামানিক বলল,আমাগো একসময় কিছুই ছিল না।কর্ম ও চেষ্টা এ দুডোই ভাগ্য পরিবর্তন করে।
এত কথার কোনকিছু বোঝার মত বয়স রুপভানের এখনো হয়নি।এদিকে তার ভাবি চুলে তেল দিয়ে বেনুনি বাঁধতে বাঁধতে বললেন কাল কোথাও বেড়ুবি না।ঘরেই থাকবি।কেন ভাবিসাব। কাল কি?সকাল হতে হতে কখন মাঠে ঘাস কাটতে চলে গিয়েছে তা বোধহয় কারো চোখেই পড়েনি।একবার বাসায় এসে কোনরকম নাকে মুখে খাবার গুঁজে আবার দৌড়।সন্ধ্যের আযান দেওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে তবুও রুপভানের দেখা নাই।ভয়ে রুপভানের বড়ভাবির মুখ শুকিয়ে এতটুকু।এদিকে সকিনা বেগমের ইচ্ছা যেকোন উপায়ে বিয়েটা ভেঙ্গে যাক।তাই বললে কি হয়। অবশেষে ভাবি একটু এগিয়ে রুপভানকে পেয়ে আদর করে কান দুটো মলে দিল।বললো,মুখপুরী তোর অপেক্ষায় মরছি আর তুই ছাগল নিয়া বেড়াচ্ছিস।শয়তান কোথাকার।পিঠের ওপর আরো দুটো কিল বসিয়ে দিল।ভাবিসাব মারো ক্যা।আবার জিগায়,ক্যা?কার হুকুমে বাইর হইছোস।মা ই তো কইলো ছাগল মাঠে নেবার কতা।আমি কি করতাম। এবার পানির মতো সব পরিষ্কার।হ বুজজি,চল।
লাল রঙের শাড়ি পড়াইয়া চোখে কাজল দিয়া তোরে তোর স্বামীর কাছে নিয়া যামু।এবার রুপভান কেঁদে বলে ভাবি আমারে এত বড় শাস্তি তুমি দিওনা।আর কোনদিনও তোমার কথার অবাধ্য হমু না।ভাবি গো আমারে নিও না।তোমার সব কতা শুনুম,ভাবি। এবার দুজনেই গলা জড়ায়ে কাঁদতে লাগল।মেয়ে মানুষদের জীবনের এটি চরম অপেক্ষামান এক অধ্যায়।
জব্বার পরামানিক এবার একখানা কথা বলার উদ্দেশ্যে কাশি দিয়ে সকলের নীরবতা ও মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো।সবাই শোনার জন্য প্রস্তুত।আমার রুপভান বিয়ার পর আরো দু বছর আমার কাছেই থাকবে।এ দুবছর আব্দুল রহমান তার মেয়ের সাথে কোনরূপ দেখা সাক্ষাত করতে পারবে না। যদি এ প্রস্তাবে রাজি থাকেন তাহলে বিয়াতে আমার কোন আপত্তি নাই।সবাই আপত্তি জানালেও আব্দুল রহমান রাজি।বিয়ে পড়ানো হলে খাওয়া দাওয়া সেরে সব চলে যায়।যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন উনিশশত উনসত্তর সাল।পৌষ মাস ছিল।
এদিকে এভাবে বউকে না দেখে রহমানের মনের মধ্যে বড্ড ছটফটানি।
কিন্তু যার জন্য এত পোড়ানি সে কবে যে স্বামী চিনবে,কে জানে!হিসেব মত দুবছর সময় দেখতে দেখতে চলে গেল। কিন্তু সময়টা বড্ড খারাপ।দেশে শুরু হয়েগেছে মুক্তিযুদ্ধ।কখন না কখন কার খারাপ খবর আসে।এ দুবছরে শারীরিক মানসিক অনেক চেতনার পরিবর্তন হয়েছে রুপভানের মধ্যে।একটু হলেও স্বামীর চিন্তায় সেও ভেতর ভেতর অস্থির।কিন্তু ভাবির চোখে ফাঁকি দেয়া যে অসম্ভব।জব্বার পরামানিক সেও চিন্তিত।এই রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে কি তবে মেয়ের জন্য তিনি বিপদ ডেকে আনলেন?অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে দেয়াটা এরা অপরাধ মনে করে না।বরং মেয়ে মানুষের বিয়েতে দেরী হওয়াটাই চিন্তার।এদিকে ভাবিকে অনেক বলে কয়ে দিন দুয়েকের জন্য তার বাপের বাড়ি আসার অনুরোধ জানালো রহমান।উদ্দেশ্য রুপভানের সঙ্গ লাভ।যাইহোক,তাই এ অসময়ে বাপের বাড়ি এলো ননদের সাথে করে।
রহমান আর রুপভানের কাছাকাছি হবার এক চরম দুঃসময় এটি।ওদিকে রহমানের নিজ ভিটাতে মিলিটারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়।তার মা তার দু ভাইবোন নিয়ে তার দুঃসম্পর্কের এক বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।এভাবে দেশে যুদ্ধের ইতি আসে নানান দাবানল স্মৃতির মধ্য দিয়ে।তবুও রহমানের সংসার পাতা, যে আরো কঠিন হয়ে পড়ছে।দেশ স্বাধীন হলে,উনিশশত বায়াত্তরের মার্চের পনেরো তারিখ তার হাতে রুপভানকে তার বাবা জব্বার পরামানিক তুলে দেয়।নতুন সংসার পাতার সময়।কিন্তু মিলিটারিরা রহমানের বাপের ভিটায় আগুন ধরিয়ে দিলে, সেখানে বাড়িঘর বলে কিচ্ছু ছিল না। সে সময় অনেক হিন্দুরা এদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। সেরকম একটা পরিত্যক্ত বাসায় রহমান তার মা,বোন,বউসহ আশ্রয় নিয়েছিল।উপরে টিন নীচে মাটির মেঝে।তবুওতো আশ্রয় মিলেছে।রহমানের মা তার নিজ ভিটাতে টিনের চাল দিয়ে আবার নতুন ঘর তোলে।ভালোই কাটছিল সময়টা।কিন্তু বিধি হল বাম।রুপভান,রহমানের সন্তানের মা হতে চলেছে, একথা শুনে রুপভানের শ্বাশুড়ি তাদের সাথে একঘরে থাকতে আপত্তি জানাল।বলল,বুঝি আসতে আসতেই ছেলের মা হয়া যায়!শোন বাবা,মিলিটারীরা মেয়েছেলেদের নিয়ে যা করেছে,তা তোর এত সুন্দরী বউরে তার বাপ মা কোন গর্তে লুকাইয়া রাখছিল শুনি?আমার টিন আমি খুইলল্যা বেচুম।নিজে বিয়া করলি বোনডার কতা মনে আহে না।এই টিন বেইচচ্যা আমি বেগার বিয়া দিমু।তোর এই কলঙ্কিনী বউ নিয়া তুই থাক। ওরম মেয়ে ছেলের হাতে পানি খাওয়া যে পাপ।না কোন পাপ নাই,ওর গর্ভে যে আমার সন্তান।
এ সন্তানের বাপ আমি।হ আমি,আব্দুল রহমান।আর কোনদিন এই পাপের কতা উচ্চারণ করবা না। বউ,আমি তোমারে আমার ভালোবাসা দিয়া আগলাইয়া রাখুম সারাজীবন।